দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে

মাসুদুর রহমান, দিনকাল : ‘দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে’-সরকারি দলের পক্ষ থেকে বারবার এমন দাবি করা হলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর  উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে সারাদেশে লুটপাটের উন্নয়ন চলছে। বিধি বহির্ভূতভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ালেও কাজের গতি বাড়েনি, বাড়েনি মান। ফাইওভার থেকে শুরু করে পদ্মাসেতুর প্রকল্পের বাস্তবায়নের অর্থ ও সময় বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। দেশের প্রধান মহাসড়কগুলোর মেরামতের নামে টাকা বরাদ্দ হলেও সকল মহাসড়ক এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশালের মহাসড়কের বেহাল দশায় পরিবহন শ্রমিক ও মালিকেরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সার দেশের ৮৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়কের এখন বেহাল দশা বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ সড়কের মেরামত না করায় সড়কগুলো এখন যানচলাচলের অনুপযোগী। ঈদকে সামনে রেখে এখনই প্রতিদিন এসব মহাসড়কের খানাখন্দের কারণে দীর্ঘ যানজট লেগে থাকছে। গত কয়েকদিনে এর চিত্র ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে  ভোগান্তির মাত্রা বাড়ছে। খোদ রাজধানী ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক ছাড়া সকল সড়ক এখন খন্ড খন্ড। অলি-গলিতেও যেন চলার উপায় নেই। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলো সেবার মান বাড়িয়ে নাগরিকদের জীবনযাত্রা সহজ করা। সে ল্েযই ঢাকা মহানগরীকে ভাগ করা হয়েছিল। কিন্তু নাগরিক সেবার মান না বেড়ে ‘উন্নয়নের অত্যাচারে’ নাগরিকদের জীবন যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে। নগরজুড়ে রাস্তার পাশে মাসের পর মাস ধরে চলছে নানা রকম খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। গর্ত খুঁড়ে তোলা মাটিও পড়ে থাকে রাস্তায়। ধুলার যন্ত্রণায় রাস্তার পাশের দোকান তো বটেই, আশপাশের বাড়িঘরেও থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে রাস্তা ভেঙে বিপজ্জনক গর্ত  তৈরি হয়েছে। কোনো রকমে যানবাহন চলাচল করে। সর্বদা যানজট লেগেই থাকে। ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে দুই ঘণ্টাও লেগে যায়। দুর্ভোগপীড়িত মানুষ এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর এক পশলা বৃষ্টি হলে তো কথায় নেই। রাজধানীর রাজপথে জমে হাঁটু কিংবা কোমর পানি। : ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের দেয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু রাজধানীতে জলাবদ্ধতায় ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক তি হবে। একটু বৃষ্টির কারণে ভোগান্তির মাত্রা ধাপ বেড়ে যায় মৌচাক-মালিবাগ বাসিন্দাদের। মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ রেলগেট এবং রাজারবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটি কয়েক বছর ধরে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে আছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় মৌচাক-মালিবাগ ফাইওভার নির্মাণ কাজ। এই প্রকল্পের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয় দু বছর। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় সময় আর ব্যয় বাড়িয়েও শেষ হয়নি এর কাজ। ভোগান্তির নির্মাণাধানী ফাইওভারটি এখন নগরবাসীর বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। ফাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই এলাকা দিয়ে চলাচলকারীরা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। ভোগান্তির কারণে অনেকেই এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বাসা নিয়েছেন। আদৌ কবে এই ফাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ হবে এর কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা। : অন্যদিকে রাজধানীর সঙ্গে দেশের সকল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটাই নাজুক যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-যশোর, ঢাকা-কুষ্টিয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-মৌলবীবাজার প্রভৃতি কোনো সড়ক-মহাসড়কই এখন স্বাভাবিক যান চলাচলের পর্যায়ে নেই। আসন্ন ঈদের আগে ঘরমুখো মানুষ প্রস্তুত হচ্ছেন বাড়ির যেতে। রাজধানীর থেকে বের হওয়ার এসব সড়কের তিগ্রস্ত অংশ জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ নির্দেশ দেয়, ঈদের সাত দিন আগে অর্থাৎ ২৫ আগস্টের মধ্যে মহাসড়কের সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে সড়ক ও মহাসড়কের ভাঙাচোরা অংশে ইট বিছিয়ে মেরামত করে সওজ। কোথাও ইট ফেলে, কোথাও বিটুমিন দিয়ে ভরাট করা হয় খানাখন্দ। তবে সংস্থাটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেরামতের পরপরই বৃষ্টি এবং অধিক যানবাহন চলাচলের কারণে আবার রাস্তা ভাঙছে। : ঢাকা থেকে রংপুরের দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটার। স্বাভাবিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে বড়জোর সাত ঘণ্টা সময় লাগার কথা। এখন লাগছে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা। এই মহাসড়কের হাটিকুমরুল থেকে বগুড়া ও পলাশবাড়ি থেকে মোকামতলা পর্যন্ত এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, রাস্তা আছে কি নেই বোঝার উপায় নেই। : এদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে মেরামতের কাজ চলছে। খানাখন্দে ভরা সড়কটি ঈদযাত্রায় ভোগান্তির কারণ। কোথাও সুরকি উঠে গেছে, কোথাও খানাখন্দ। যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটছে। কোথাও চলছে ধীরগতিতে। সামনে ঈদ। যাত্রী ও যানবাহনের চাপ আরও বাড়ছে। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য খানাখন্দ ও গর্ত থাকায় এ সড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও যানবাহনের চালকদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। কোথাও দেখা দিচ্ছে যানজট। মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ অংশও বেহাল। ভাঙাচোরা থাকায় সড়কের হাটিকুমরুল থেকে রংপুর অংশেও যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে মহাসড়ক সংস্কারের কাজ শেষ করতে পারেনি সড়ক বিভাগ।  ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পার থেকে রংপুর পর্যন্ত প্রায় ১৪০ কিলোমিটার সড়কটির বেশির ভাগ এলাকায় অসংখ্য ভাঙাচোরা গর্ত ও খানাখন্দ। অন্য সময় হাটিকুমরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা লাগত। এখন বেহাল সড়কে ধীরগতির কারণে সময় লাগছে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। এর ওপর দুই সপ্তাহ ধরে মহাস্থানে করতোয়া সেতুতে ফাটল দেখা দেয়ায় যানবাহন পারাপার হচ্ছে একমুখী। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের ৩২ কিলোমিটার অংশ পড়েছে গাইবান্ধা জেলার সীমানায়। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফাঁসিতলা থেকে সাদুল্যাপুর উপজেলার ধাপেরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত এই মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানে কার্পেটিং উঠে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। :  গোবিন্দগঞ্জ হাইওয়ে থানার ওসি আবুল বাসার বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই মহাসড়কে ৩২টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ৩৬ জন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। : কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশের প্রায় ২০ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। একটু বৃষ্টিগুলো সেগুলো ভরে যায়। বেহাল এই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন গাড়িচালক ও যাত্রীরা। রাস্তায় খানা-খন্দ থাকায় তীব্র ঝাঁকুনিতে অনেক সময় গাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র ভেঙে যায়। আবার অনেক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, উজানিসার পর্যন্ত অংশের প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে বড়-বড় গর্ত হয়ে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। : সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, জেলা সড়কগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এমত পরিস্থিতিতে ঈদযাত্রীদের দুশ্চিন্তার অবধি নেই। : মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, প্রতিবছরই সড়ক-মহাসড়ক মেরামত ও পুনর্র্নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করা হয় এবং সেই বরাদ্দ নিতান্ত কম নয়। অথচ তার একটা বড় অংশই লুটপাট হয়ে যায়। অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না এবং কাজের মানও হয়না সন্তোষজনক। চুরি বন্ধ ও কাজের মান যথাযথ না হলে সড়ক-মহাসড়ক মসৃণ ও নির্বাধ যাতায়াতের উপযোগী কখনোই হবে না। : পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেছেন, মেরামত পদ্ধতিতে গলদ রয়েছে, এ কারণেই সংস্কারের পর আবার রাস্তা ভাঙছে। দুই মাস আগে ঈদুল ফিতর উপলে মহাসড়ক সংস্কার করা হয়েছে। ঠিকভাবে মেরামত করা হলে দুই মাসে নষ্ট হওয়ার কথা নয়।

No comments

Powered by Blogger.